কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা দেশ ও জাতিকে কি দিয়েছে?
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা জাতির উন্নতির সোপান। শিক্ষা জাতিকে মূর্খতার হীন অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে শিক্ষা মানুষকে সুন্দর, পরিমার্জিত ও আদর্শ মানব হিসাবে গড়ে তোলে। তবে মানব রচিত শিক্ষা ব্যবস্থা কখনো দেশ ও জাতির সামগ্রীক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না এক মাত্র মাদ্রাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাই মানুষের জাগতিক ও পরকালিন সুখ-শান্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে।
মাদ্রাসার পরিচয়:
মাদ্রাসা হলো আদর্শ মানব তৈরীর আদর্শ কারখানা। যেখানে দ্বীনের দাঈ ও সিপাহী তৈরী হয় মাদরাসা হলো ইসলামী বিশ্বের বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখান থেকে ইসলামী জনপদ বরং সমগ্র মানব বসতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। মাদরাসা হলো মন ও মস্তিস্ক এবং অন্তর ও অন্তর্দৃষ্টি তৈরির কারখানা। মাদরাসা হলো গোটা বিশ্বের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ এবং সমগ্র মানব জীবনের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনের মহানকেন্দ্র। মাদরাসা হলো নবুয়াতে মুহাম্মদীর চিরন্তনতা এবং মানব জীবনের গতিশীলতার মিলন মোহণা। মাদরাসা হলো সবচেয়ে সুরক্ষিত ও শক্তিশালী ইসলামী দুর্গ। এর এক প্রান্তের সংযোগ হলো নবুয়াতে মুহাম্মদীর সঙ্গে এবং অন্য প্রান্তের সংযোগ হলো জীবন ও জগতের সাথে।
মাদরাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য:
মাদরাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো নৈতিক, সত্যবাদী, সৎ চরিত্রবান, আদর্শ মানুষ গড়া। যারা মানবতাকে কোরআনের বাণী শুনাবে। মানুষের মাঝে কোরআনের আলো ছড়াবে। পথহারা বিভ্রান্ত মানব কাফেলাকে মুক্তির পথ দেখাবে। মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের উপকার করা। তোমার ঘরে বাতি না জ্বলুক, অন্যের ঘরে যেন আলো থাকে। তুমি পেটে পাথর বাধো, যেন পরবর্তিদের মুখে আহার জোটে। মাদরাসার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো মানব রচিত শিক্ষার বিষফল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে ইসলামের অনুপম শিক্ষা তুলে ধরার মাধ্যমে সুসংহত আদর্শিক ইসলামী সমাজ গঠন। সারা বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জন সহ বিজাতীয় সংস্কৃতির গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করা। মাদরাসা শিক্ষার মূল লক্ষ উদ্দেশ্য হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন মানব সমাজকে আলোকোজ্জল মুক্তির রাজপথে উঠিয়ে দিয়ে, সভ্যতার আলোঝলমল নগরীতে পৌঁছে দেয়া। মানুষের মাঝে মানবতা বোধ জাগিয়ে তোলা। মানুষের মধ্যকার পত প্রবৃত্তিকে খতম করে তাকে ফেরেশতার মত পুত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী করে তোলা মাদরাসার উদ্দেশ্য হলো স্রষ্টা-প্রেম ও সান্নিধ্য চেতনায় মানবাত্মাকে উন্মুখ করে তোলা। যাতে জাগতিক মোহমায়া ছিন্ন করে মানুষ ছুটে চলে জান্নাতের প্রত্যাশায়।
মাদরাসা শিক্ষার অবদান:
সর্ব প্রথম মসজিদে নববীতে ছুফফা নামে শুরু হয় কওমী মাদরাসার অগ্রযাত্রা। আর বর্তমানে তা এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার সুবিশাল পরিধিতে বিস্তার লাভ করেছে। জন্ম দিয়েছে সাহাবা (রা.) এর মত ব্যক্তিত্বদের যাদের পরশে মাটি খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। যাদের প্রতি মহান আল্লাহ খুশি হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, ড়رضی الله عنهم ورضوا عنه
রোমান এম্পায়ার ও পারসিয়ান এম্পায়ারের পক্ষ থেকে আইন কানুনের আকারে যে চ্যালেঞ্জ ধেয়ে আসছিল, তার দাঁত ভাঙা জবাব দিতে কওমী মাদ্রাসা পেশ করলো ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মত ব্যক্তিত্বকে তিনি ইসলামী আইন কানুনের এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন যা দেখে তখনকার বড় বড় আইনজ্ঞরা হতভম্ব হয়ে গেল।
ভারত বর্ষে আকবরের যুগে যখন ইসলামের অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন। যখন রাষ্ট্রিয় শক্তির দাপটে মুসলমানদের কে একটি নতুন ধর্ম মানতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এমন নাজুক মুহুর্তে কওমী মাদরাসা জাতিকে উপহার দিলো সায়্যিদ আহমাদ সরহিন্দি (রহ.) এর মত ব্যক্তিত্বকে। ইতিহাসে যিনি মুজাদ্দেদে আলফে সানী নামে পরিচিত। তিনি তার বলিষ্ঠ ঈমানী চেতনায় ছিন্ন করে দিলেন আকবরের সব ষড়যন্ত্রের জাল। ভোগবাদী বস্তুতান্ত্রিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে বাতিল যখন নিজেকে দাঁড় করাতে চাইলো তখন এর মুকাবেলায় এগিয়ে এলেন নববী চেতনায় উজ্জীবিত সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুজতাহিদ ও শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সংস্কারক শাহ ওলি উল্লাহ দেহলবী (রহ.)। যিনি মোঘল সম্রাজ্যের ভাঙ্গন, সামাজিক বিশৃংখলা ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য বৈপ্লবিক আন্দোলন করেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার আগ্রাসনের মাধ্যমে হিন্দুস্থান যখন এক নতুন ফেতনার মুখোমুখি হতে চলছিল। ঠিক তখনই ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুন এবং উলূমে নবুয়াতের হেফাজত ও সংরক্ষনের জন্য মাওলানা কাসেম নানুতুবি (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। যিনি ছিলেন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি।
দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমেই শুরু হয় উপমহাদেশের কওমী মাদরাসার অগ্রযাত্রা। দারুল উলূম দেওবন্দ জাতিকে উপহার দেয় উপমহাদেশের স্বাধিনতা আন্দোলনের - অগ্রনায়ক শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহ.) এর মত বীর গেণানী। মুজাদ্দেদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) এর মত মহান সমাজ সংস্কারক । মাওলানা ইলিয়াছ (রহ.) এর মত একনিষ্ঠ দাঈ, ইলাল্লাহ মুবাল্লিগ ও শাইখুল ইসলাম, হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) ও শিব্বীর আহমাদ উসমানী (রহ.) এর মত যুগ শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবীদ । আরেফ বিল্লাহ, কুতুবে রাব্বানী হাফিজ্জী হুজুর (রহ.) সহ অসংখ্য প্রতিথ যষা উলামায়ে কিরাম এ মাদরাসা শিক্ষার ফসল। মুক্তিকামী মানুষের, মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনে এমন কোন দিক নেই, এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে কওমী মাদরাসার উলামায়ে কিরাম নেতৃত্বের উজ্জল সাক্ষর রাখেনি। কি ঈমান ও আকাঈদ আখলাক ও নৈতিকতা। তাজকিয়া ও রুহানিয়াত। দারস ও তাদরিস। জিহাদ ও রাজনীতি, দাওয়াত ও তাবলীগ, তাগণীফ ও তালীফ, দরসে কুরআন, দরসে হাদিস, কি ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টিতে, কি নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে সমাজ বিনির্মানে।
মোট কথা মানব কল্যাণ কমিতায় ও উসওয়ায়ে নবুওয়াতের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে কওমী মাদরাসার অবদান নেই। কওমী মাদরাসার অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তাদের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত আজও দ্বীনের আলোক মশাল জ্বলিয়ে রেখেছে। এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পজ্জ্বলীত রাখবে ইনশাআল্লাহ।
