ফিকহ্ এর চার ইমাম।


📚 ফিকহ্‌ এর চার ইমাম

🔰 ভূমিকা

নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় দ্বীনের যাবতীয় আহকাম (বিধান) কেবল ওহীনবীজীর উক্তি ও আমল থেকেই গ্রহণ করা হতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর সাহাবা এবং তাবেয়ীনের যুগে ইসলামী জ্ঞান বিস্তৃত হয়ে পড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে—যেমন, মিশর, ইরাক, হেজাজ ইত্যাদি।

সেই সময় ফিকহ বা ইসলামী আইন ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আলেমদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ দেখা যায়। তবে এই মতভেদ বিভ্রান্তিকর নয়, বরং তা বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কোরআন ও হাদীসকে বুঝার এক গঠনমূলক প্রচেষ্টা।


🕋 হেজায ও ইরাক: ফিকহের দুই কেন্দ্র

🕌 হেজায (মক্কা-মদিনা)

  • হাদীসের সনদ ও মতন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হেজাযের আলেমগণ ছিলেন অগ্রগামী।

  • ইমাম মালেক (রহ.) এই ধারার একজন শ্রেষ্ঠ ফিকহবিদ, যিনি “মুয়াত্তা মালেক” নামে একটি বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ রচনা করেন।

  • এ কিতাবটি হাদীস ও ফিকহ উভয়ের ভিত্তিতে সংকলিত।

🏛️ ইরাক (কুফা)

  • ইরাকের আলেমগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক।

  • তারা অনেক সময় রাসূল (সা.)-এর নাম সরাসরি উল্লেখ না করে নিজেদের কথা বলে বর্ণনা করতেন, যেন ভুলভাবে নবীজীর নামে কিছু না বলা হয়।

  • এই ধারার প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.)। তিনি শিষ্যদের নিয়ে ফিকহের একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি প্রণয়ন করেন।


🏛️ চার ইমাম ও তাঁদের মাযহাব

1️⃣ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) (৮০–১৫০ হি.)

  • অবস্থান: ইরাক

  • বৈশিষ্ট্য: কিয়াস, যুক্তি ও বিশ্লেষণভিত্তিক ফিকহ নির্মাণ।

  • তাঁর মাযহাব: হানাফী মাযহাব

  • শিষ্য: ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান


2️⃣ ইমাম মালেক (রহ.) (৯৩–১৭৯ হি.)

  • অবস্থান: মদীনা

  • বৈশিষ্ট্য: “আহলে মদিনা”র আমলকে দলীল হিসেবে গ্রহণ। হাদীস সংকলনে অগ্রগামী।

  • বিখ্যাত কিতাব: মুয়াত্তা মালেক

  • তাঁর মাযহাব: মালিকী মাযহাব


3️⃣ ইমাম আশ-শাফীঈ (রহ.) (১৫০–২০৪ হি.)

  • অবস্থান: প্রথমে মক্কা, পরে মিশর

  • বৈশিষ্ট্য: হানাফী ও মালিকী উভয় ফিকহ ধারার সংমিশ্রণে স্বতন্ত্র মাযহাব গঠন।

  • শিক্ষা: ইমাম মালেক (রহ.) থেকে হাদীস, ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) থেকে ফিকহ।

  • বিখ্যাত গ্রন্থ: আর-রিসালাহ

  • তাঁর মাযহাব: শাফীঈ মাযহাব


4️⃣ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) (১৬৪–২৪১ হি.)

  • অবস্থান: বাগদাদ

  • বৈশিষ্ট্য: হাদীসের বাহ্যিক অর্থে আমল, তবুও যুক্তিকেও গুরুত্ব দেন।

  • বিখ্যাত কিতাব: মুসনাদ আহমদ

  • তাঁর মাযহাব: হাম্বলী মাযহাব


📝 চার মাযহাবের পূর্ববর্তী অন্যান্য ইমামগণ

চার ইমামের যুগের আগে ও পাশাপাশি আরও অনেক প্রখ্যাত ইমাম ও তাঁদের মাযহাব ছিল। যেমন:

  • ইমাম হাসান বসরী (রহ.)

  • ইমাম আউযায়ী (রহ.)

  • ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)

  • ইমাম দাউদ জাহেরী (রহ.)

  • ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (রহ.)

  • ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহ.)

  • ইমাম লায়েছ ইবনে সাদ (রহ.)

  • প্রমুখ...

তাঁদের মাযহাবগুলো ৩য় থেকে ৮ম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, এরপর ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

🟡 বিশেষত:

ইমাম দাউদ জাহেরী (রহ.)-এর মাযহাব ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল।
তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল—হাদীসের বাহ্যিক শব্দগ্রাহ্য করে আমল করা এবং কিয়াস ও যুক্তিকে বর্জন করা।


📌 কেন চার মাযহাব অনুসরণ জরুরি?

  • ফিকহে চারটি নির্ভরযোগ্য মাযহাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, মুসলমানদের জন্য ঐক্য ও সুরক্ষার লক্ষ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে:

সাধারণ মুসলমানদের জন্য চার মাযহাবের মধ্য থেকে যেকোনো একটি অনুসরণ করাই নিরাপদ ও জরুরি।

✅ উদ্দেশ্য:

  • যেন কেউ নিজের স্বার্থে এক মাযহাবের কিছু মাসআলা গ্রহণ করে আরেক মাযহাবের থেকে সুবিধাজনক মাসআলা নিয়ে দ্বীনকে খণ্ডিত না করে।

  • একনিষ্ঠভাবে একটি মাযহাব অনুসরণ করা মানেই কোরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী চলা।


🔚 উপসংহার

চার ইমামের মাযহাব শুধু ইতিহাসের অংশ নয়; বরং তারা দ্বীনের গভীরতম বোঝাপড়ার বাস্তব রূপ
আজও কোটি কোটি মুসলমান তাঁদের মাযহাব অনুসরণ করে দ্বীনের উপর অবিচল থাকার চেষ্টা করছেন।

✅ তাই সাধারণ মুসলমানের জন্য:

  • চার মাযহাবের যেকোনো একটিকে গ্রহণ করা,

  • সেই অনুযায়ী জীবন গঠন করা,

  • দ্বীনের সঠিকতা ও ঐক্য রক্ষা করা—এই সবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url